ছোটবেলা থেকেই অনেক শখের একটা জিনিস ছিল সাইকেল। অনেক চেষ্টা করেও শিখে উঠতে পারেনি তখন। এমনকি আমার বাবাও অনেকবার শেখানোর ট্রাই করে ব্যর্থ হয়েছে। তখন বুঝিনি সাইকেলগুলো ছিল বড় , আমার হাতের নাগালের বাইরে, তাই কখনো শিখে উঠতে পারেনি। আমার সব সময় মনে হতো এই জিনিসটা আমাকে দিয়ে আর হবে না। এখন বুঝতে পেরেছি তখন শেখার পদ্ধতিটাই ভুল ছিল।খুব অসহায় বোধ করেছিলাম।আমি মন প্রাণ দিয়ে কিছু শিখতে চেয়েছি আর সেটা শিখতে পারিনি তা এটাই ছিল প্রথম। যা শিখতে চেয়েছি যা করতে চেয়েছি তার সবটুকু করতে পেরেছি ছোটবেলা থেকেই। মাটিকাটা থেকে শুরু করে বেড়া বানানো আরো নানান ধরনের কাজে বাবার পাশাপাশি থেকে বাবাকে সাহায্য করেছি এবং বাবার কাছ থেকে শিখেছি অনেক কিছু। এইজন্যেই বাবা সব সময় আমাকে বলতো - আমি তার মেয়ে নই আমি তার ছেলে।
০২
এভাবে কেটে গেল দীর্ঘ কয়েকটা বছর, আমার আর সাইকেল শেখা হলো না এই দীর্ঘশ্বাস নিয়েই। বিয়ের তিন বছরের মাথায় একদিন খানপুর হাসপাতালের ভেতরের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দেখতে পেলাম মেয়েরা সাইকেল চালানো শিখছে। ফারজানা মৌসুমী হচ্ছে তাদের ট্রেনার। আমি কৌতুহলবশতঃ এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- আমি শিখতে চাই তুমি কি আমাকে শেখাবে? ও রাজি হয়ে গেল। ঠিক আছে আপু আপনি কবে আসবেন বলেন। আমি লোভ সামলাতে না পেরে বলেই ফেললাম - কালকে থেকে আসতে চাই। সেদিন থেকেই শুরু হল আমার জীবনের আরেকটি নতুন দিক।
আমার বয়স তখন ৩৪ আমার সঙ্গে ছিলো দুইজন এইচ এসসি পড়ুয়া স্টুডেন্ট। বয়সের এত পার্থক্য নিয়ে ওদের সাথে সাইকেল চালাতে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ কাজ করেনি। এদের মধ্যে একজন এখন আমার স্টুডেন্ট। তবে মৌসুমীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ আমি প্রথম দিনই সাইকেলে প্যাডেল দিতে শিখে যাই। তারপর আমাকে আর থামায় কে...
০৩
দীর্ঘদিন, ট্রেনিংয়ের ছোট সাইকেলটাই আমি চালিয়েছি নির্লজ্জের মতো। সেটা দিয়ে খানপুর হাসপাতাল থেকে চানমারি আমার বাসা, আমার বাসা থেকে খানপুরে মায়ের বাড়ি, এইভাবে প্র্যাকটিস করেছি অনেকদিন। তারপর আর তর সইছিল না। তড়িঘড়ি করে টাকা জোগাড় করে নতুন একটা সাইকেল কিনেই ফেললাম। সাইকেলের রংটা কিন্তু আমার পছন্দের রং লাল। আমার সাইকেল কিনা দেখে আমার খুব কাছের বিখ্যাত একজন মানুষ বলেছিল - সুমনা এটা তোমার একটা খেলনা, মোহ কেটে গেলে দুদিন পরে আর ভালো লাগবে না। আমি তাকে উত্তরে বলেছিলাম আপনি আমাকে চেনেন না!
তারপর থেকে সাইকেল হয়ে যায় আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। নারায়ণগঞ্জ শহরে কোথায় যাইনি আমি সাইকেল দিয়ে। এমনকি আমি আমার অফিস করতাম সাইকেল দিয়ে। সুযোগ পেলেই লং রাইডে চলে যেতাম। মুন্সীগঞ্জে গিয়েছি বেশ কয়েকবার।
০৪
রাস্তায় চলতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে, প্রশংসা ও বিড়ম্বনা দুটোই পেয়েছি। একদিন এক ট্রাফিক আমাকে তো বলেই ফেলল - আপা আপনাকে দেখতে খুব ভালোই লাগে। তবে মাঝে মাঝে রিক্সাওয়ালারা আমার সাথে পাল্লা দিয়ে রিক্সা চালায়, আমি খুব মজা পাই। আমিও কম কীসে? মাঝে মাঝে তাদেরকে ফেলে খুব দ্রুত সাইকেল চালিয়ে যখন সামনে চলে যাই তখন রিকশাওয়ালারা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
একদিন চাষাড়া থেকে ডিআইটি যাওয়ার পথে একটা সিএনজি আমাকে একটু হালকা ধাক্কা মেরে চলে যায়। এতে আমার কোন ক্ষতি হয়নি শুধু একটু ভয় পেয়েছি। পরক্ষণেই বুঝতে পারি ও আমাকে ভয় দেখিয়েছে। সিএনজিটা সামনে গিয়ে জ্যামে পড়েছে আর আমি এদিক ওদিক কাটিয়ে সাইকেল নিয়ে খুব দ্রুতগতিতে ওকে ধরার জন্য ডি আই টি সিগন্যালে চলে যাই। সিএনজির ড্রাইভার কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওকে আমি আচ্ছা করে ধমক দেই। ড্রাইভার হা হয়ে যায়, আর ভেতরে থাকা যাত্রীদের মধ্য থেকে একজন বলে - আপা ছেড়ে দেন। মাঝে মাঝে এরকম অনেক ঘটনা ঘটে। আমি অবশ্য খুব মজা পাই। একদিন তো এক ট্রাক ড্রাইভার আমাকে দেখে পাশ থেকে কি যেন একটা বলে। আমি ঐদিন খুব দ্রুত সাইকেল চালিয়ে ওকে গিয়ে ধরি। ডিআইটির মোড়ে থাকা ট্রাফিকের কাছে ওর নামে নালিশ করি, ট্রাফিক ওকে জরিমানা করে এর জন্য।
সেদিনও দেখেছি ট্রাক ড্রাইভার ও হেলপার হা হয়ে তাকিয়ে ছিল। আর আমি মনে মনে 'আহা কি আনন্দ' গানটি গাইতে গাইতে সাইকেল টান দিয়ে আমার কর্মস্থলে চলে আসি।
যেটা না বললেই নয়- বিশেষ করে বাচ্চাদের দেখেছি ওরা খুবই অবাক হয়। ওরা চিৎকার করে বলে - ওই দেখ দেখ মাইয়া মানুষ সাইকেল চালায়। আমি হাসতে হাসতে ওদের বলি - এই প্রথম দেখলা? ভালো কইরা দেখে নাও। আর টিনএজারদের বলতে শুনি - মেয়ে মানুষ ভেলোজ চালায়! এত কিছুর ভিড়ে সাইকেলটা আমার প্রতিদিনের সঙ্গী।
দিনদিন সাইকেলের প্রতি ভালোবাসাটা বেড়েই চলছে। বাইরে বের হব সাইকেল ছাড়া এটা আর ভাবতেই পারি না। আমাকে তো শহরের অনেকেই এখন সাইকেল আপা বলে ডাকে। আমার কিন্তু শুনতে মন্দ লাগে না। এখন শুধু অপেক্ষায় আছি কবে আমার ছেলে বড় হবে, কবে মা ছেলে একসাথে সাইক্লিং করব।
©
Sumana Akter
No comments:
Post a Comment