লেটেস্ট

Post Top Ad

Your Ad Spot

Tuesday, November 3, 2020

অপ্রকাশিত

 ২০০৮ সালের তেঁতুলিয়া টেকনাফ সাইকেল ভ্রমণের পরে সাহস অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এর পরে অনেক জায়গায় গিয়েছি একা একা সাইকেলকে সঙ্গী করে। একা একা ভ্রমণের বেশিরভাগ গল্পই লেখা হয় নাই। অথবা কিছু কিছু লেখা লিখলেও কোথাও প্রকাশ করা হয় নাই। এখানে অপ্রকাশিত একটা লেখার কিছু অংশবিশেষ সবার সাথে শেয়ার করি। পুরাটা হয়তো অন্য কোন একদিন।

অফিসের তিন দিনের ছুটিতে ঠিক করেছিলাম বরিশালের দিকে ঘুরতে যাব। এর আগে একবার বরিশাল গেলেও এটা ছিল দ্বিতীয়বার বরিশাল ভ্রমণ এবং সঙ্গী সাইকেল। এরপরে বহুবার বরিশালে গিয়েছি। সাইক্লিংয়ের জন্য উত্তরবঙ্গের পরেই বরিশাল এলাকাটা আমার খুব পছন্দের। যথারীতি সদরঘাট থেকে পারাবত-২ লঞ্চে রওনা দিলাম বরিশালের উদ্দেশ্যে। লঞ্চ ছাড়ার আগ পর্যন্ত নিচেই অপেক্ষা করলাম সাইকেলের আশেপাশে। লঞ্চ ছাড়ার পরে নিশ্চিন্ত মনে উপরে চলে গেলাম। কারণ আর যাই হোক সাইকেল নিয়ে কেউ অন্তত নদীতে লাফ দিবে না।

ভোর ৫ টায় বরিশাল নামলাম। লঞ্চের লোক সাইকেলের জন্য কোন ভাড়াও নিল না। বরং খুব খুশী হয়েছে সাইকেলে বরিশাল দেখতে গিয়েছি। এমন একটা অবস্থা আমি উনাদের এলাকায় গিয়ে উনাদেরই সম্মানিত করেছি। এখন অবশ্য ঐ দিন নাই। এখন তো ১০০ টাকার নিচে কথাই বলা যায় না। যাই হোক লঞ্চ ঘাট থেকে বের হয়ে সোজা চলে গিয়েছিলাম ঝালকাঠি হয়ে পিরোজপুর। পথে রাজাপুর নামে একটা বাজারে সকালের নাস্তা করেছিলাম।
পিরোজপুর গিয়ে সরাসরি ডিসি অফিসে। ডিসি মো: তাজুল ইসলাম সাথে দেখা করে বললাম স্যার ঘুরতে আসছি একটু থাকার ব্যবস্থা করে দেন। তিনি সবকিছু শুনে বললেন, ‘আসছেন খুব ভাল হয়েছে। আপনাকে শুভেচ্ছা। এনডিসি সাহেবের কাছে যান উনি ব্যবস্থা করে দিবেন আমি বলে দিচ্ছি।’ এনডিসি মো: সামছুল ইসলাম সাহেবের কাছে যাওয়ার পরে তিনি সার্কিট হাউজে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে বিকাল পর্যন্ত ঘুমালাম। তারপর বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত শহরেই ঘুরাফেরা।


সকালে উঠলাম সাড়ে সাতটায়। ফিরবো বরিশাল তবে ভিন্ন পথে। ভিন্নপথে কাউখালী স্বরূপকাঠি দিয়ে বরিশাল যাওয়ার রাস্তাটা। বেকুতিয়া ফেরি পার হয়ে যখন একা একা চালাচ্ছি তখন পরিচয় হলো স্থানীয় একজনের সঙ্গে নাম সাইদ। তিনি আমার সঙ্গে কাউখালী পর্যন্ত আসলেন নানারকম বিষয়ে দুইজনে গল্প করেছিলাম। কাউখালি থেকে স্বরূপকাঠির রাস্তায় আরেকজন সঙ্গী হলো আরেক ভাই নাম ইমাম হোসেন। পথের এই মানুষগুলার সঙ্গে পরিচয় এবং কথাবার্তা বলাটা একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। একা না থাকলে এইসব মানুষদের খুব একটা কথা হয়ই না।

অদ্ভূত সুন্দর একটা নদী সন্ধ্যা। নদীটা পার হলাম ট্রলারের মাধ্যমে। ঘাটের নাম রাজবাড়ি, এলাকার নাম গুয়ারেখা। রাস্তাটা অসম্ভব সুন্দর, সাইকেল রিক্সা ছাড়া কিছু চলে না। অবশ্য কিছু মটরসাইকেলও চোখে পড়েছিল। প্রথমেই চোখে পড়লো রাজবাড়ি ডিগ্রি কলেজ। তারপর পড়ল এগার গ্রাম সম্মেলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ঢাকার বাইরের এলাকার এইসব নামগুলাও আমার কাছে খুব ভাল লাগে। স্কুলের পাশেই একটা টং দোকানের মত দোকান ছিল সেখানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছিলাম এমন সময় একজনের সাথে টুকটাক আলাপ চলছিল। ঢাকা থেকে এসছি জানার পরে তিনি নিজের এলাকার ভাষার বাইরে গিয়ে ঢাকা অথবা চলিত ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতে লাগলেন। এই বিষয়টা আমার খুবই মজা লাগে। চলিত ভাষার সঙ্গে মিশে যখন এলাকার ভাষার টান যুক্ত হয় তখন শুনতে খুবই ভাল লাগে। যাঁর সঙ্গে হচ্ছিল তাঁর নাম মাখনলাল সিকদার। এই স্কুলেরই বাংলার শিক্ষক।

স্যার খুবই চমৎকৃত হলেন আমার কার্যক্রমে। তখন একটা কাজ আমি সব সময় করতাম। কারণে অকারণে। সেটা হইল তেঁতুলিয়া টেকনাফ সাইকেল ভ্রমণের পরে কয়েকটা পত্রিকায় খবর বের হয়েছিল। আমি সব সময় সেই পত্রিকা কাটিংগুলা নিয়ে ঘুরতাম। আর কথা কথায় লোকজনকে বলে বেড়াতাম আমি এই কাজটা করেছি। নানারকম ছুতায় পত্রিকার কাটিংগুলা দেখাতাম। এইগুলা করলে যেটা হতো সবাই আলাদা চোখে দেখতো। এতে আমার আনন্দ হতো। এখানেও স্যারের সঙ্গে ব্যতিক্রম করি নাই। পত্রিকার খবরাখবর ছবি দেখে স্যার আমাকে আলাদা সমাদর করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু আমি এখন জানি এভাবে শুধু শুধু নিজেকে জাহির করাটা ঠিক না। এইটা এক ধরনের অহংকার।

তেঁতুলিয়া টেকনাফ ভ্রমণ শুধু নিজেকে এক ধরনের সেটিসফেকশন দিয়েছে। অন্য কারও কোন কাজেই লাগে নাই। বরং এই শিক্ষক যে কাজটা করে আসতেছেন দিনের পর দিন সেটাই আসল কাজ। এই বোধ আসতে আমার অনেক সময় লেগেছে। সেটাও শিখেছি এই সাইকেল ভ্রমণের মাধ্যমেই এবং ততদিনে অনেক সময় চলে গেছে জীবন থেকে। এখনো যে সেই অহম থেকে বেরিয়ে গেছি সেটাও বলতে পারবো না বুকে হাত দিয়ে। যেখানে ‘আমি’ শব্দের মানেই ‘অহম’ সেখান থেকে কিভাবে বের হবো? সেই রাস্তাটা এখনো খুঁজে পাই নাই...

গুয়ারেখা ইউনিয়নের সেই প্রত্যন্ত এলাকায় আরেকজন মানুষের কাছে ঋনী হয়ে আছি। সুন্দর আঁকাবাকা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম দুই পাশেই গাছ, একদম গাছের সুরঙ্গ দিয়ে যাচ্ছি এমন। রাস্তার পাশেই এক মহিলা বসেছিল। উনাকে ক্রস করে চলে যাচ্ছি হঠাৎ মহিলার ডাক, ‘কে যাচ্ছে?’ আমি সাইকেল থামালাম। অনুমান করার চেষ্টা করলাম মহিলার বয়স কত হতে পারে। ৮০ বছরের কম না। তিনি চোখে দেখেন না তাই জিজ্ঞাসা করেছেন কে যায়। মনে হচ্ছিল শাহ আব্দুল করিমের ‘গাড়ি চলেনা’ গানের চরিত্র সামনে বসে আছে।
আমি আমার নাম বললাম। তারপরের প্রশ্ন কোত্থেকে আসা হয়েছে? উত্তরে ঢাকা বলার পরে উনার পাল্টা প্রশ্ন এইটা কোথায়? মনে হলো উনি সম্ভবত অনেক কিছু মনেও করতে পারেন না। কারণ ঢাকা চেনে না এটা কেমন কথা? আমি আবার বললাম শহর থেকে এসেছি। এবার তাঁর উত্তর, ‘ও বুঝতে পারছি নদীর ঐপার থেকে।’ নদীর ঐপার মানে হইল স্বরূপকাঠী। আমি তাঁকে আবার বুঝানোর জন্য বললাম না নদীর ঐপার না, ঢাকা শহর থেকে আসছি। তারপর তিনি আবার বললেন, ‘ও বুঝতে পারছি বরিশাল।’ আমি বুঝতে পারলাম তাঁর স্মৃতি থেকে সম্ভবত ‘ঢাকা শহর’ শব্দটা মুছে গেছে।

তবে তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম তাঁর কাছে স্বরূপকাঠীই শহর। আর বড় শহর হইল বরিশাল। এবং তিনি কোনদিন নদী পার হয়ে স্বরূপকাঠীতে যান নাই। বরিশাল আর ঢাকা শহর তো আরো পরের বিষয়।

এই আশি উর্ধ্ব মহিলা আমাকে অদ্ভুত এক কঠিন সত্যির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন। একজন মানুষ জীবনের শেষ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন। অথচ তিনি নদীটা পার হয়ে কোনদিন ঐ পাড়ে যান নাই। অথচ সারাটা জীবন এখানেই কাটিয়ে দিয়েছেন। এটা কিভাবে সম্ভব? এভাবেও জীবন পার করে দেয়া সম্ভব!

এই মহিলা আমায় এমন একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন যে, সেই ঘোর থেকে আমি আজও বের হতে পারি নাই!
এই ট্রিপের কোন ছবি নাই। তখন আমার ক্যামেরা ছিল না। আর স্মার্ট ফোনও এতটা সহজলভ্য ছিল না। এই ছবি অন্য একটা ভ্রমণে সন্ধ্যা নদীর পাড়ে। তুলেছেন মুনিম চৌধুরী।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ইহা এক‌টি পুরাতন লেখা।
আ‌মি সাধারণত চেষ্টা করি যে কোন ভ্রম‌ণেই যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলতে। আশা করি আপনারাও এই চেষ্টা করবেন।

©মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Your Ad Spot